পরিচিতি
“তাঁত বোনা” শব্দটি এসেছে “তন্তু বয়ন” থেকে। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।
তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতা থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভন্ন রকমের হতে পারে । খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটিরশিল্প।
তাঁত শিল্পের ইতিহাস
তাঁত শিল্পের ইতিহাস সঠিক বলা মুশকিল ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। এদেরকে এক শ্রেণীর যাযাবর বলা চলে- শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়ায় শাড়ির মান ভালো হচ্ছে না দেখে তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন, চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। ধামরাইয়ে কাজ শুরু করতে না করতেই বসাকরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভাগ হয়ে অনেক বসাক চলে যান প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে। এর পর থেকে বসাক তাঁতিরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়া’ এ দু’গ্রুপে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
তাছাড়া তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে, তাঁত শিল্পী মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে। মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার; যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশা করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারী ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয়।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পের উৎপত্তি ও প্রসার
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রনে টাঙ্গাইল যায় এবং পরবর্তিতে সেখানে বসবাস শুরু করে। শুরুতে তারা নকশাবিহীন কাপড় তৈরী করত। ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের ল্যাঞ্চশায়ারের তৈরী কাপড় বর্জন করা। এই সময়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) -এর তাঁত শিল্পের প্রসার লাভ করে। ১৯২৩-২৪ সালে তাঁতের কাপড়ে নকশা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩১-৩২ সালে শাড়ি তৈরীর জন্য জাকুয়ার্ড তাঁত প্রবর্তন করা হয়।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পের বৈশিষ্ট্য ও বর্তমান অবস্থা
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প কুটির শিল্পও এবং তাঁতগুলো তাঁতীদের বাড়ির অভ্যন্তরে বসানো হয়। ৭২% কুটিরশিল্প পাঁচটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ১১% তাঁত ছয় থেকে দশটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং ৬% তাঁত এগার থেকে বারোটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবশিষ্ট ১১% কুটিরশিল্প বারো এর অধিক তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত। বারো এর অধিক তাঁত সংবলিত কুটিরশিল্পগুলো ছোট কারখানা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৯২ সালে, টাঙ্গাইল জেলায় ১ লাখের অধিক তাঁত ছিল এবং ১৫০০০০ তাঁতী সদর, কালিহাতি, নাগরপুর ও বসিল উপজেলায় বসবাস করত। ২০০৮ সালে ১০০০০০টি ছোট ও বড় কারখানায় ৩৭২২২টি তাঁত ছিল এবং ৭০০০০ তাঁতী টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেসিক সেন্টার এর অধীনে কাজ করত। ২০১৩ সালের একটি শুমারীতে পাওয়া তথ্যমতে, টাঙ্গাইল জেলায় ঐ সময়ে ৬০,০০০ তাঁত ছিল। এর মধ্যে ৮৩০৫ টি পিট তাঁত, ৫১১৪১ টি চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং ৮৯২ টি পাওয়ার তাঁত। বর্তমানে সর্বমোট ৩,২৫,০০০ জন তাঁতী, মালিক ও ব্যবসায়ী-ক্রেতা এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত।
আমাদের অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। হস্ত চালিত তাঁতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয় যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে। এ শিল্প থেকে মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের হস্ত চালিত তাঁত শিল্প এদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। সরকার কর্তৃক সম্পাদিত তাঁত শুমারী ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লক্ষাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। দেশের মোট কাপড়ের চাহিদার শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ যোগান দিচ্ছে তাঁত শিল্প এবং প্রায় ৫০ লাখ লোক সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প এর একক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতীরা বিশেষ দক্ষতার মাধ্যমে টাংগাইল শাড়ি তৈরী করে। পাটাইল ইউনিয়নের বসাক সম্প্রদায় সব থেকে পুরোন সম্প্রদায় যারা এখনো আদি ও ঐতিহ্যবাহীতার সাথে তাঁতের শাড়ি তৈরী করে। এই শাড়ি তারা বাজিতপুর ও করটিয়া হাটে সপ্তাহে দুই দিন বিক্রি করে। ৩০০-২০,০০০ টাকায় টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হয়ে থাকে।
রপ্তানি
টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যপক চাহিদা আছে এবং ইন্ডিয়া, আমেরিকা, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশেষত টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতে খুব সমাদৃত। প্রতি সপ্তাহে ভারতে ৫০,০০০ টাঙ্গাইল শাড়ি রপ্তানি হয়।
তাঁত শিল্পে বিদ্যমান সমস্যা
কুটির শিল্প হিসেবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প বৃটিশ পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বর্হিবাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল। বংশ পরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যদিয়ে বয়ন উৎকর্ষতায় এ দেশে তাঁতীরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য স্থান। কিন্তু বৃটিশ আমলে অসম করারোপ, তাঁত ব্যবহারের উপর আরোপিত নানা বিধি নিষেধ, বৃটিশ বস্ত্রের জন্য বাজার সৃষ্টির নানা অপকৌশলের কাছে তাঁতী সমাজ তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। ক্রমান্বয়ে তাঁত শিল্পে সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। স্বাধীনতার পরও সে সংকটের তেমন কোন সুরাহ হয়নি। বাজার অর্থনীতি সম্প্রসারণে তাঁতীদের সমস্যা আরো জটিল করে তুলেছে। বর্তমানে মুক্ত বাজার অর্থনীতির আড়ালে হচ্ছে পরোক্ষ আগ্রাসনের শিকার নানা ধরণ, নানা রং, নানা ডিজাইনের কাপড়ের অবাধ প্রবেশের ফলে বাজার চলে গেছে সনাতনী তাঁতীদের প্রতিকূলে। মুদ্রা অর্থনীতির প্রসারের ফলে দেখা দিয়েছে পুঁজি সংকট। সে সুযোগে মহাজনের কাছে সেবাদাসে পরিণত হয়েছে অধিকাংশ প্রান্তিক তাঁতী ও তাঁত মালিক। সুতা, রং রসায়নের জন্য মহাজনের কাছে জিম্মি হয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাঁতীদের।
তাঁত, রঙ ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও পরিবহন সুবিধার অব্যবস্থার কারণে টাংগাইল তাঁতশিল্প ঝুকির সম্মুখিন হচ্ছে। এ কারণে অনেক তাঁতী এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে এবং অন্যত্র চলে যাচ্ছে।